শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:২১ অপরাহ্ন

প্রসঙ্গ ডেঙ্গু : মেয়রদের পদত্যাগ করা উচিত

প্রসঙ্গ ডেঙ্গু : মেয়রদের পদত্যাগ করা উচিত

প্রসঙ্গ ডেঙ্গু : মেয়রদের পদত্যাগ করা উচিত

ওসমান এহতেসাম : ইদানীং দেশজুড়ে চলছে ডেঙ্গুর রাজত্ব। ডেঙ্গুর অত্যাচারে রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। আমাদের দেশে গতবছরের এ সময়ের তুলনায় বর্তমান সময়ে ডেঙ্গুর ঘনত্ব বেড়েছে প্রায় চার গুণ। দেশে ডেঙ্গুর উপদ্রব এতটায় বৃদ্ধি পেয়েছে যে রাত্রে তো বটেই, দিনেও ডেঙ্গুর আক্রমণ থেকে কেউ রক্ষা পাচ্ছে না।

জানা গেছে, কয়েল জ্বালিয়ে, ওষুধ ছিটিয়ে, মশারি টাঙিয়ে ডেঙ্গুর উপদ্রব থেকে নিস্তার পাওয়ার চেষ্টা করছেন অনেকে। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। দিনে বাচ্চাদের মশারি টাঙিয়ে ঘুম পাড়াতে হয়।

বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে দেশের সর্বত্র ডেঙ্গু দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও স্বস্তিতে কাজ করা যাচ্ছে না। রাস্তা-ঘাটে, দোকান-পাটে কোথাও বসতে পারি না, কোথাও দাঁড়াতে পারি না, আড্ডা দিতে পারি না, পাঁচ মিনিটের জন্য এর মধ্যে ১০-২০টা ডেঙ্গু কামড়িয়ে রক্তচোষে নেয়। হা করলে মুখের ভেতর ঢুকে পড়ে ডেঙ্গু। এছাড়াও কানের কাছে ভনভন শব্দ তো আছেই। ঘরে বাইরে সব জায়গায় ডেঙ্গু আর ডেঙ্গু। গরমের দিনে একদিকে যেমন গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ, তেমনি ডেঙ্গুর যন্ত্রণায় জীবন আরও বেশি যন্ত্রণাদায়ক।

ডেঙ্গুর সংক্রমণে আক্রান্ত হাসপাতালের বিছানায় হাজারো মানুষ। বিশ্বে এখন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার আমাদের দেশেই সবচেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) দেশের হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৩ জন। যা এই বছর একদিনে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু৷ একই সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৫৩৩ জন৷ এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১২৭৷

জানা যায়, নতুন আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৭৯ জন, আর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৫৪ জন৷ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট পাঁচ হাজার ৫৬৯ জন ডেঙ্গুরোগী চিকিৎসাধীন৷ ঢাকায় বর্তমানে তিন হাজার ৪৪৩ জন এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে দুই হাজার ১২৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন৷ চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত ২৪ হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে মোট সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ১৮ হাজার ৩০৪ জন৷ গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ২৮১ জন মারা গেলেও এবছর তা ছাড়িয়ে যাবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কারণ এবছর শেষ হতে এখনোও পাঁচ মাসের বেশি সময় বাকি।

সারা দেশের ন্যায় ডেঙ্গু সংক্রমণে পিছিয়ে নেই চট্টগ্রামও। জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের তথ্যমতে, সোমবার চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২ জন। এ নিয়ে গত সাড়ে ছয় মাসে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৬ জনের মৃত্যু হলো। তাই এমন সমীকরণে ডেঙ্গু এখন রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশের জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

প্রতিদিনই খবরে শুনি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের অভিযান। কোথায় এ অভিযান? মশকনিধন কর্মীদের দেখাই তো মেলে না। তাহলে সিটি কর্পোরেশনের মশকনিধন কার্যক্রম কি শুধু লোক দেখানো! ডেঙ্গু দুর্যোগ মোকাবেলায় সিটি কর্পোরেশনের মেয়রা গণমাধ্যমে যতটা সরব কাজে ততটা ব্যর্থ। ডেঙ্গু মোকাবেলায় সরকার ও জনগণের সমন্বিত প্রয়াস জরুরি হলেও সিটি কর্পোরেশন এলাকার কাউন্সিলরদের অবহেলার কারণে ডেঙ্গু এখন দুর্যোগে পরিণত হয়েছে।

জনগণ নিয়মিত ট্যাক্স পরিশোধ করলেও সিটি কর্পোরেশনের নাগরিক সেবা থেকে বরাবরই জনগণ বঞ্চিত। অভিযোগ আছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সব এলাকায় নিয়মিত মশার ওষুধ না ছিটানো, ফগিং-এর সময় গলির মধ্যে না গিয়ে মেইন রাস্তায় ফগিং করাসহ লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা আদায়, ডোবা-নালা নিয়মিত পরিষ্কার না করায় সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম কোনো কাজে আসছে না। কাজেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের স্পষ্ট ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ। এ ব্যর্থতার দায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিছুতেই এড়াতে পারেন না।

সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও প্রতিকারে নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, এর আগেও নিয়েছে, সামনেও হয়তো-বা নেবে। এখন মনে হচ্ছে নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি নয়, ডেঙ্গু মারাই যেন তাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। মহানগরীর উন্নয়নের নামে নগরবাসীর কাছ থেকে যে উচ্চহারে কর আদায় করা হয়, তার একটা বড় অংশ এখন ব্যয় করা হয় এই কাজে। কিন্তু ডেঙ্গু কতটুকু নির্মূল হবে, বা নিয়ন্ত্রণে আসবে, তা কেবল সৃষ্টিকর্তাই বলতে পারেন, আপাতত তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ উদ্যোগ কেবল গণমাধ্যমেই নেয়া হয় তার কোন বাস্তবায়ন নেই।

তাই মশা নিধনে গাফিলতি এমন পরিণতি অনিবার্য করে তুলেছে।

ডেঙ্গু সংক্রমণের দায় নাগরিক, সিটিকর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকারের। তবে ঘরে ঘরে প্রবেশ করে ডেঙ্গি মারা যেমন সিটি কর্পোরেশনের কাজ নয়, তেমনি ঘরের বাইরে এডিস মশার ডিম পাড়া ও বংশবৃদ্ধি রোধ করা সিটি কর্পোরেশন, স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব। এটা ঠিক যে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে যেমন লোক দরকার, সিটি করপোরেশনের তেমন দক্ষ লোক নেই। লোক না থাকার কারণে সিটি করপোরেশন তা করতে পারছে না। তাই বলে মেয়রা যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকেন তাহলে তো হবে না। মেয়রদের সদিচ্ছা থাকতে হবে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের মেয়রদয় হেঁটে বেড়াচ্ছেন, খুঁজে বেড়াচ্ছেন কোথায় লার্ভা আছে বা নাই। এমনটা কি হওয়ার কথা ছিল? আসলে সব কিছুর জন্য প্রয়োজন পূর্ব প্রস্তুতি আর একটি স্থানী ব্যবস্থাপনা। তারা পূর্ব প্রস্তুতি না নিয়ে কেবল সিজন এলেই এই করবেন সেই করবেন বলে আমাদের সান্ত্বনা দেন কিন্তু আগে থেকেই করেননি কেন সেই জবাবটা কার কাছে চাইবো আমরা? কেউ কি আছে এই জবাব দেওয়া চাওয়ার?

এমন প্রশ্নে মেয়ররা হয়তো জনগণের উপর দোষ চাপাবেন, কিন্তু তা বলাটা তাদের উচিত হবে না। কারণ জনগণকে সচেতন করাটাও সিটি কর্পোরেশনের কাজ। নাগরিক সেবার দায়িত্ব নিয়ে দায়িত্ব পালন না করা ও মশা নিধনে স্থায়ী অভিযান পরিচালনা না করে সাধারণ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ায় এখনই মেয়রদের পদত্যাগ করা উচিত। স্বীকার করা উচিত নিজেদের ব্যর্থতা। সেই সাথে আমাদের নিজেদের সচেতন হওয়া উচিত।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।’ তাই আমাদেরও একলা চলতে হবে। মেনে নিতে হবে মেয়র নামের কোন শব্দ এ পৃথিবীতে নেই। তাই নিজেদের বাঁচা নিজেদের বাঁচতে হবেে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চাইলে আমরা মেয়রদের চেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারি। আমাদের উদ্যেগে আমাদের কাজ করতে হবে। যেখানে সেখানে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত পাত্র, মাটির হাঁড়ি, টায়ার, ক্যান যার মধ্যে জমা পানি থাকে বা কোনো গর্ত যেখানে বৃষ্টি হলেই পানি জমতে পারে সেখানেই নির্মূলের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ কেবল কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ থাকলেই হবে না। ডেঙ্গুমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সর্বস্তরের জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সচেতনতা সৃষ্টি করা যাবে না, কেবল কাজ দিয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত ডেঙ্গু নিধন হবে না।

তাই মশার লার্ভা নিধনে অনতিবিলম্বে আমাদের যার যার যায়গা থেকে কাজের তৎপরতা বাড়াতে হবে। প্রথমত, আমরা সবখানে মশা নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জোরদার করব এবং পাশাপাশি আন্তরিকতার মাধ্যমে কার্যক্রমকে পর্যবেক্ষণ করব।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |